কালসর্প দোষ: রেহাই কিসে?
- ভাগ্যফল
- Jan 15
- 5 min read
সোমা দত্ত খারে
(সি.এ (ইন্টার), স্বর্ণমুকুট, কে.পি মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী, সনাতন, কৃষ্ণমূর্তি, হস্তরেখাবিদ, সংখ্যাতত্ত্ববিদ ও বাস্তুবিদ)

কালসর্প যোগ তখনই হয় যখন জন্মছকে রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র এবং শনি—এই সাতটি গ্রহ রাহু ও কেতুর মাঝখানে থাকে। কোনো জাতচক্রে কালসর্প যোগ দোষ আছে কিনা তা জানতে প্রতিটি গ্রহের ডিগ্রি জানা অত্যন্ত জরুরি। যেমন, যদি শনির 110 হয় এবং কেতুর 110 কম হয় তাহলে বুঝতে হবে সেক্ষেত্রে কালসর্প দোষ নেই। রাহু এবং কেতুর ডিগ্রি বাকি সাতটি গ্রহের ডিগ্রির থেকে বেশি হলে তবেই পূর্ণ কালসর্প যোগ দোষ হতে পারে।

সাধারণত এই যোগ থাকলে সেই জাতক বা জাতিকাকে সারাজীবন সংগ্রাম করে যেতে হয়। যেকোনো ক্ষেত্রে যেমন, শরীর-স্বাস্থ্য, অর্থ, কর্ম, দাম্পত্য, সন্তান ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে বাধা আসে। দ্বাদশভাবে রাহু ও কেতুর অবস্থানের ওপর নির্ভর করে কার জাতচক্রে কালসর্প যোগ কী কী ক্ষেত্রে কুপ্রভাব বিস্তার করবে।

বারোটি কালসর্প যোগ আছে। নীচে অল্পবিস্তর আলোচনা করা হল।
অনন্ত কালসর্প যোগ : যখন রাহু লগ্নে এবং কেতু সপ্তমে থাকে এবং বাকি সাতটি গ্রহ রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের মধ্যে থাকে তখন এই যোগ সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে দাম্পত্য জীবনের ওপর অশুভ প্রভাব বিস্তার করে। দেরীতে বিবাহ হয়, বিবাহের পরে অসুখী হয় দাম্পত্য জীবন। লগ্নে রাহু থাকায় সারাজীবন সংগ্রাম করতে হয় এবং সপ্তমে কেতু থাকায় স্বামী বা স্ত্রী অসুস্থ থাকে।

কুলীক কালসর্প যোগ : যখন রাহু দ্বিতীয়ে এবং কেতু অষ্টমে এবং বাকি সাতটি গ্রহ রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের মধ্যে থাকে। এক্ষেত্রে লেখাপড়ায় বাধা আসে, অমার্জিত ভাষা ব্যবহার করে থাকে, নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যেহেতু রাহু দ্বিতীয় অর্থাৎ ধনস্থানে থাকে তাই অর্থাভাব দেখা দেয়। তাছাড়া কেতু অষ্টমে যদি নীচস্থ থাকে তাহলে দুর্ঘটনা ঘটারও সম্ভাবনা।
বাসুকী কালসর্প যোগ : যখন রাহু তৃতীয়ে এবং কেতু নবমে এবং বাকি সাতটি গ্রহ রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের মধ্যে থাকলে বাসুকী কালসর্প যোগ সৃষ্টি হয়। এহেন জাতক-জাতিকার ভাগ্য করুণ হয়। ভাগ্য সহায় হয় না। এছাড়া ছোট ভাই বা বোনের সঙ্গে সৎভাব থাকে না।

শঙ্খপাল কালসর্প যোগ : যখন রাহু চতুর্থে এবং কেতু দশমে এবং বাকি সাতটি গ্রহ রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের মধ্যে থাকে তখন এই যোগ সৃষ্টি হয়। এদের ছোট থেকেই কিছু বদঅভ্যাস জন্মায়। যেমন মিথ্যা বলা, ুলে না যাওয়া, নেশা করা, পড়াশোনায় ফেল করা। তাছাড়া সন্তানের জন্মের পর থেকে বাবা-মায়ের নানারকম সমস্যা আসতে থাকে। কর্মজীবনেও কোনো উন্নতি করতে পারে না।

পদ্ম কালসর্প যোগ : রাহু পঞ্চমে ও কেতু একাদশে এবং বাকি সাতটি গ্রহ রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের মধ্যে থাকলে এই যোগ সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে লেখাপড়া, সন্তানের জন্ম, প্রেম, প্রেম বিবাহ, রোজগার প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাধা আসে। কখনো কখনো সন্তানের দীর্ঘকাল স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে থাকে।

মহাপদ্ম কালসর্প যোগ : এই যোগ তখন হয় যখন রাহু ষষ্ঠে ও কেতু দ্বাদশে এবং বাকি সাতটি গ্রহ রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের মধ্যে থাকে। এই ক্ষেত্রে কর্মে বাধা আসে। কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। আইনি সমস্যা, শত্রুতা, স্বাস্থ্যহানি, দীর্ঘকাল হাসপাতালে থাকা, অহেতুক খরচ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।

তক্ষক কালসর্প যোগ : যখন রাহু সপ্তমে এবং কেতু লগ্নে এবং বাকি সাতটি গ্রহ রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থান করে। এক্ষেত্রে বিবাহিত জীবন প্রচন্ডভাবে অসুখী হয়। শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ। ব্যবসায় ক্ষতি বিশেষ করে অংশীদারি ব্যবসা করলে। কখনো কখনো স্বামী-স্ত্রী একই ছাদের তলায় থেকেও একে অপরের সঙ্গে অপরিচিতের মতো ব্যবহার করে।
করযোটক কালসর্প যোগ : যখন রাহু অষ্টমে, কেতু দ্বিতীয়ে এবং বাকি সাতটি গ্রহ রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের মধ্যে থাকে। এই সব জাতক-জাতিকার জীবন খুবই দুঃ খজনক হয়। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে ভাগ্য তাকে সঙ্গ দেবে না।
শঙ্খচূড় কালসর্প যোগ : যখন রাহু নবমে, কেতু তৃতীয়ে এবং বাকি সাতটি গ্রহ রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের মধ্যে থাকে তখন এই যোগের সৃষ্টি হয়। জাতক-জাতিকার বাবার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ থাকে। এক্ষেত্রে পিতৃদোষের সৃষ্টি হয়। ভাগ্য খারাপ হয়। আর্থিক সমস্যা হয়। বন্ধুবান্ধবরা ঠকিয়ে থাকে। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দেয়।

ঘাতক কালসর্প যোগ : যখন রাহু দশমে, কেতু চতুর্থে এবং বাকি সাতটি গ্রহ রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের মধ্যে থাকে তখন এই যোগ হয়। রাহু দশমে থাকায় কর্মজীবনে ঝামেলা লেগেই থাকে। তা চাকরি হোক কী ব্যবসা যাই হোক না কেন। এরা মায়ের থেকে দূরে থাকে। বাবা ও মা দু’জনেই দীর্ঘকাল ধরে অসুস্থ থাকতে পারেন।

বিষধর কালসর্প যোগ : রাহু একাদশে, কেতু পঞ্চমে এবং বাকি সাতটি গ্রহ রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থান করলে এই যোগের সৃষ্টি হয়। জাতক-জাতিকার চোখের সমস্যা এবং হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। বড় ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে থাকে। লেখাপড়া মনে রাখতে অসুবিধা হয়। সন্তানের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো যায় না।

শেষনাগ কালসর্প যোগ : যখন রাহু দ্বাদশে, কেতু ষষ্ঠে এবং বাকি সাতটি গ্রহ রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের মধ্যে থাকে তখন শেষনাগ কালসর্প যোগের সৃষ্টি হয়। এই যোগের ফলে জাতক-জাতিকাকে সারাজীবন আইনি সমস্যায় জর্জরিত থাকতে হয়। জাতক-জাতিকাদের প্রায়ই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়। দ্বিতীয় বিবাহের যোগ থাকতে পারে।
কালসর্প যোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় আছে। আর যারা একবার রেহাই পেয়ে যান তারা জীবনে উচ্চ প্রতিষ্ঠিত, গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব হতে পারেন। প্রথমত, মহারাষ্টের ত্রম্বকেশরে এই কালসর্প যোগ খন্ডন করা হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে ভাগ্য আপনার সহায় আছে কিনা আগেই জেনে নিন। তার কারণ আজকাল অসৎ লোকে ভরে গেছে দেশ। ওখানে যারা নিজেদের এই ব্যাপারে পন্ডিত বলে পরিচয় দেয় তাদের অধিকাংশই এই ব্যাপারে অজ্ঞ। আপনার কাছ থেকে প্রচুর টাকা নিয়ে পুজো করিয়ে বলে দেবে এই দোষ খন্ডন হয়ে গেছে। ওরা জানে আপনি পর্যটক, স্থানীয় বাসিন্দা নন। আপনি ভাববেন এই দোষ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কিছুদিন পরে বুঝতে পারবেন কিছুই হয়নি। তখন আপনি কিন্তু ত্রম্বকেশর ফিরে গেলেও সেই ব্যক্তিকে খুঁজে পাবেন না যে আপনার পুজো করিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, অনেকে মনে করেন ক্যাটস্ আই এবং গোমেদ ধারণ করলে এই দোষের খন্ডন হয়। অথচ এই দুটি রত্ন আপনার কতটা সর্বনাশ করতে পারে, তা কল্পনারও অতীত। যেমন ধরা যাক, যার অনন্ত কালসর্প যোগ আছে তাকে যদি গোমেদ ও ক্যাটস্ আই ধারণ করানো হয় তাহলে সে জীবনে কিছু করে উঠতে পারবে না। তার কারণ লগ্ন হচ্ছে মাথা। সেখানে রাহু থাকলে এবং তার প্রতিকার হিসাবে গোমেদ দিলে জাতক-জাতিকা জীবনে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবে। যদি এর সঙ্গে ক্যাটস্ আই দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে বিবাহিত জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠবে, শত্রুতা বৃদ্ধি পাবে ইত্যাদি।
আবার যার কুলীক কালসর্প যোগ, তাকে গোমেদ ও ক্যাটস্ আই ধারণ করালে সে সবসময় অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করবে। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে মোটেই সদ্ভাব থাকবে না। অর্থনাশ হবে। ক্যাটস্ আই ধারণে দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। শরীরে অস্ত্রোপচার হতে পারে। সুতরাং রত্নে কখনোই কালসর্প যোগের প্রতিকার করা যায় না।

তৃতীয়ত, বিশেষ ক্রিয়ার সাহায্যে কবচ বা তাবিজ তৈরি করে যদি জাতক-জাতিকা ধারণ করতে পারে তাহলে এই যোগ অবশ্যই খন্ডন করা যায়। তবে সবাই এই কবচ বা তাবিজ তৈরি করতে পারে না। আজকাল অধিকাংশ কবচের ভিতরে নানারকম দ্রব্য ভরে দিয়ে লোককে ঠকনো হয়ে থাকে। কোনো অভিজ্ঞ জ্যোতিষের কাছে গিয়ে এই কাজ করাবেন। কে সৎ বা অসৎ সে বিচার আপনাকেই করতে হবে। তবে শুধু কবচ ধারণ করলে হবে না, এর সঙ্গে নিয়মিত মন্ত্র জপ করতে হবে। মন্ত্রের শক্তিতে সব অশুভ শক্তির নাশ হয়ে শুভ শক্তির সূচনা হবে। যে যতবার মন্ত্র জপ করতে পারবেন সে তত তাড়াতাড়ি শুভ ফল পাবেন। কারণ মন্ত্রশক্তির কাছে বাকি সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়।

আমাদের দেশের অনেক বড় বড় নেতা, অভিনেতা, খেলোয়াড়দের কালসর্প যোগ ছিল, আছে। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই জীবনে স্বক্ষেত্রে, স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠেছেন। সুতরাং আর দেরী না করে যদি আপনার জাতচক্রে কালসর্প যোগ থাকে তাহলে তা কোনো ভালো জ্যোতিষীকে দিয়ে খন্ডন করিয়ে নিন।
এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা না বললে লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এখানে পূর্ণ কালসর্প যোগের কথা আলোচনা করা হয়েছে। অনেক সময় কোনো একটি গ্রহ (শনি ও বৃহস্পতি ছাড়া) যদি রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের বাইরে থাকে এবং বাকী ছয়টি গ্রহ রাহু ও কেতুর ক্ষেত্রের ভিতরে থাকে তাহলে তাকে আংশিক কালসর্প যোগ বলা হয়ে থাকে। এই যোগ পূর্ণ কালসর্প যোগের মতোই ফল প্রদান করে।
Comments