জীবনে শনিদেবের রোষ
- ভাগ্যফল
- Mar 14
- 2 min read
Updated: Apr 1
(জ্যোতিষ ভারতী, জ্যোতিষ শাস্ত্রী, জ্যোতিষাচার্য, জ্যোতিষ বাচষ্পতি, কৃষ্ণমূর্তি ও ভাবস্ফূট পদ্ধতি বিশেষজ্ঞ, বাস্তু বিশারদ, ফেংশুই বিশেষজ্ঞ, সংখ্যাতত্ত্ববিদ, হস্তরেখাবিদ ও তন্ত্র বিশারদ

1610 খ্রিস্টাব্দে ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে প্রথম শনিগ্রহ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ভর ও আকারে সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহ এবং সূর্যের দূরত্ব অনুসারে ষষ্ঠ নিকটতম গ্রহ। শনির ঘূর্ণন সময়কাল ভয়েজার মহাকাশ যান অনুযায়ী 10 ঘন্টা 39.4 মিনিটের মতো। শনির ভর পৃথিবীর ভরের চেয়ে 95 গুণ। শনি গ্রহ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে প্রায় 30 বছর। শনির বৃহত্তম উপগ্রহ টাইটান।

পরাশরীয় ভাষ্যকার উৎপল ভট্টের কথায়, সৃষ্টির প্রথমে সূর্য অত্যধিক তাপ বিকিরণ করে দেব-দেবী-মনুষ্যদের ও বিশ্ব চরাচর দহন করে। সেই তেজ সহ্য করতে না পেরে সকলের মিলিতভাবে প্রার্থনা জানান প্রজাপতি ব্রহ্মাকে। লোকপতি ব্রহ্মার আদেশে সূর্যদেব অতি তেজ কমানোর জন্য ক্রুদ্ধ হলেন। সেই ক্রোধ থেকে শনি মহারাজের জন্ম হয় । শনি গ্রহ তাই পাপগ্রহ। পুরাণ অনুসারে সূর্যদেবের স্বর নামক রাশি দ্বারা পুষ্টি লাভ করেন সূর্যপুত্র শনি। তিনি হলেন দার্শনিক। তাঁর মাতা হলেন ছায়া দেবী। চিত্ররথের কন্যার স্বামী হিসাবে পরিচিত। পরম ধার্মিক শনিদের কঠোর তপস্যার জন্য সংসার বিমুখ ছিলেন। তার জন্য স্ত্রী ছায়ার অভিশাপে বিনাশকারী বা ধ্বংসকারী দৃষ্টির অধিকারী হয়েছিলেন।
কালপুরুষের অঙ্গবিভাগ অনুসারে শনিদেব রাশিচক্রে দশম ও একাদশ ঘরের অধিপতি, যা যথাক্রমে মকর ও কুম্ভ রাশি। মকর রাশি পৃথ্বী উপাদান ও চর শক্তি। মকরের শনি মহারাজ ঋণাত্মক রাশি ও আত্মশুদ্ধির কারক গ্রহ। তিনি কামনা-বাসনা ও তম ভাব থেকে সাত্ত্বিকতার পথে নিয়ে যান। আত্মশুদ্ধির মধ্য দিয়ে নিম্নস্তর থেকে ঊর্দ্ধস্তরে উন্নীত করেন। আবার কুম্ভ রাশি বায়ু উপাদান ও স্থির শক্তি দ্বারা গঠিত। মূলত্রিকোণস্থ এই ঘরে নিরাকারের স্থান নেই। ধনাত্মক রাশি হলেও শনি এখানে বার্ধক্যের প্রতিমূর্তি। শিল্পকলা ও সৌন্দর্য্যের কোনো মূল্য নেই এবং পরিবর্তনও চান না। শনি মহারাজ দুঃ খদায়ক হলেও আধ্যাত্মিকতা ও পবিত্রতার সঙ্গে রয়েছে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বৈরাগ্য। সকল গ্রহদের মধ্যে শনি হলেন হলেন ধীরগতির গ্রহ। শনি গ্রহের দৈনিক গতি হল প্রায় 2 মিনিট। একটি রাশিতে প্রায় 21–বছর অবস্থান করে।

শনি গ্রহের দিক বল—পশ্চিম। জাতি—শূদ্র। বণ—কৃষ্ণ, গোত্র—কাশ্যপ, দেশ—সৌরাষ্ট্র। লিঙ্গ—নপুসংক বা ক্লীব, প্রিয়ধূপ—কালাগুরু। প্রিয়ধাতু—সীসা ও লোহা। রত্ন—নীলা। প্রকৃতি—স্থির, বৃদ্ধ, শুষ্ক, ধাত—শ্লেষা। উপরত্ন—অ্যামেথিস্ট। মূল—শ্বেতবেড়েলা। অবতার—কূর্ম, দেবী—দক্ষিণাকালী। মন্ত্র—‘ওঁ ঐং হ্রীং শ্রীং শনৈশ্চরায়। জপ সংখ্যা—10,000 বার। সমিধ—শামী, বেদীতে স্থান—পশ্চিম দিক। বেদীতে মন্ডল—ধনুষ আকৃতি। পুজার উপকরণ—কৃষ্ণবর্ণ দ্রব্য। ভোগ দ্রব্য—তিল পিষ্টক। দক্ষিণা—কৃষ্ণ গাভী। রাশির অধিপতি—মকর ও কুম্ভ। কবচ ও মন্ত্র—দক্ষিণাকালী। নক্ষত্র—পুষ্যা, অনুরাধা ও উত্তরভাদ্রপদ। অধিদেবতা—যম। প্রত্যাধিদেবতা—প্রজাপতি। পরিমাণ—চার আঙ্গুল। স্বক্ষেত্র—কুম্ভ রাশি ও মকর রাশি। তুঙ্গস্থ রাশি—তুলা। মূলত্রিকোণ—কুম্ভ রাশি।

শনিদেবকে পাপগ্রহ ও মহা-দুঃখদাতা গ্রহ বলা হয়। এই গ্রহ আয়ু, মৃত্যুর কারক ও কর্মফলদাতা গ্রহ। ইনি হলেন সংসারত্যাগী, পরমযোগী, পরম পবিত্র। ইনি মানুষকে কষ্ট দিয়ে খাঁটি মনুষ্যে পরিণত করেন। অধর্মের পথ থেকে ধর্মের পথে নিয়ে আসেন। শনি গ্রহটির চারিদিকে বৃত্তের আকারে বলয় রয়েছে। এই বলয় বরফ, ধূলিকণা ও শিলা থেকে গঠিত। সেই বলয় থেকে একটি বিশেষ বেগুনী রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়, যা মানুষের উপর বিরাট প্রভার বিস্তার করে থাকে। এই রশ্মির জন্য শনি গ্রহের কাজ অন্য গ্রহের থেকে আলাদা। এই রশ্মির প্রভাবের জন্যে শনি অশুভ হলে মানুষ কষ্ট পায়, দুঃ খ পায়, অঙ্গবিকৃত হয়, গুরুজনদের হারায় এবং আর্থিক ছাড়াও নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়। আবার শনি বলবান বা শুভ হলে আশাতিরিক্ত শুভ ফল দান করে। শনি গ্রহের বলয়গুলি 27 ডিগ্রি কোণ করে থাকে।

শনি তুঙ্গস্থ, মূলত্রিকোণস্থ, সুক্ষেত্রস্থ, মিত্রক্ষেত্রগত, গুরুসৌরী যোগ সৃষ্টি হলে সাধারণত শুভ ফল দান করে। এছাড়া মিথুন ও কন্যা রাশি শনিদেবের প্রিয়। শনিদেবের সমক্ষেত্র হল ধনু রাশি ও মীন রাশি, যা দেবগুরু বৃহস্পতির স্বক্ষেত্র। অর্থাৎ এই সকল স্থানে শনি গ্রহের অবস্থান শুভ হয়। শনি যেখানে অবস্থান করে সেই স্থান থেকে তৃতীয়, সপ্তম ও দশম স্থানে পূর্ণ দৃষ্টি দেয়। আবার জাতক বা জাতিকার জন্মেছকে লগ্নকে ধরে তৃতীয়, ষষ্ঠ, দশম ও একাদশ ভাবে (উপচয় স্থান) শনি গ্রহের বল বৃদ্ধি হয়। শনি জাতচক্রে বলবান হলে শুভ ফল দেয়। শনি গ্রহ বলবান অর্থ সেই স্থানটি শনির তুঙ্গক্ষেত্র, মূলত্রিকোণ ক্ষেত্র, মিত্রক্ষেত্র, সমক্ষেত্র হতে হবে। তার সাথে যদি মিত্র ক্ষেত্রগুলি কোনোরকম সম্পর্ক করে সেক্ষেত্রে শুভ ফল দেবে। শুভ স্থান—
শনি-বৃহস্পতির একত্রে অবস্থানে গুরুসৌরী যোগ শুভ ফল দান করে।

শনি লগ্ন সাপেক্ষে তৃতীয় স্থানে স্থিত হলে জাতকের সবরকমের উন্নতির সম্ভাবনা তৈরি হয় এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে। শুভ শনি ষষ্ঠে স্থিত হলে জাতক-জাতিকাকে প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করতে সহায়তা করে এবং বিভিন্ন শত্রুতা থেকে রক্ষা করে। দশম স্থানে অবস্থান করলে জাতক জাতিকার কর্মযোগ তৈরি করে বা যোগাযোগ করে দেয় এবং বেকার থাকতে দেয় না। শনি একাদশে শুভ ফল দেয়, পরিশ্রম করলে সাফল্য আসে। অর্থাৎ একাদশে কোনো গ্রহই খারাপ ফল দেয় না। শনি বলবান ও শুভ হলে জাতকের শান্ত স্বভাব, ধীর-স্থির, পন্ডিত, অধ্যবসায়, কর্মঠ, গম্ভীর প্রকৃতি, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, চরিত্র ভালো হয় এবং সুবিচারক হয়। দশমপতি শনি বৃহস্পতি অপেক্ষাও উপকারী।
শনি লগ্ন সাপেক্ষে কেন্দ্রে স্থিত হলে সাধারণত শুভ হয়। সাধারণভাবে বলবান শনি শুক্র ও বুধের সংস্পর্শে শুভ হয়। কোনো স্থানে পরিশ্রমী কর্মচারীদের নেতৃত্ব দিয়ে উপার্জন করবেন। কিন্তু নিজে অলস হবেন। আবার জাতক যদি নিয়মশৃঙ্খলা মেনে ইউনিফর্ম পরিষেবাগুলি করেন, সময়ানুবর্তিতা মেনে চলেন, নিয়মিতভাবে কাজ ও আদেশ পালন করেন, সেক্ষেত্রেও শনি বলবান হয়। মনে রাখতে হবে, শনি D1 Chart-এ দুর্বল হতে পারে, কিন্তু D9 Chart-এ ভালো স্থানে ভালো ফল দান করে। মকরস্থ শনি দীর্ঘস্থায়ী রোগ দেয়। মীন রাশির শনির শুভত্ব কম।

শনি গ্রহকে রাশিচক্রে টাস্ক মাস্টার হিসাবে বর্ণনা করা হয়। যা কর্তৃত্ব, গঠন ও শৃঙ্খলার প্রতীক। বৈদিক ও পাশ্চাত্য জ্যোতিষ শাস্ত্র উভয়ক্ষেত্রেই শনি সময়, সীমাবদ্ধতা ও দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য অর্জনের জন্য যে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়, শনি তার প্রতিনিধিত্ব করে। বৈদিক জ্যোতিষ শাস্ত্রে শনি ন্যায় ও কর্মের সঙ্গে যুক্ত। গ্রহটি কঠোর পরিশ্রম ও সততাকে পুরস্কৃত করে। তবে এটি ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই হোক না কেন, অতীতের কর্মের পরিণতির দান করে। এটি ধৈর্য ও লক্ষ্যের দিকে কাজ চালিয়ে যাবার ইচ্ছা দাবি করে। এই কারণেই শনি বার্ধক্য, জ্ঞান ও দক্ষতার সাথে যুক্ত থাকে তা কেবল সময়ের সাথে সাথে অর্জন করা যায়। যারা দায়িত্ব গ্রহণ করে ও চেষ্টা চালায় তাদের শনি পুরষ্কৃত করেন। শনিকে তুষ্ট করার জন্য বৈদিক জ্যোতিষ শাস্ত্রে নির্দিষ্ট আচার ও প্রতিকারগুলি করা হয়। যেমন—মন্ত্র পাঠ করা, প্রার্থনা করা ও দাতব্য কাজ সম্পাদন করা, বিশেষ করে যাদের প্রয়োজন তাদের প্রতি। যাই হোক, শনি শিক্ষা দেয়, জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্বগুলি প্রায়শই অধ্যবসায় ও সময়ের মাধ্যমে আসে। যেগুলি একবার শেখা হলে, কখনো ভোলা যায় না।
জাতচক্রে শনি অশুভ হওয়ার ফলে জাতক জাতিকার জীবনে প্রচুর দুর্ভোগ বহন করতে হয়। যাকে বলা যায়—জীবনে শনির রোষ। এই রোষের কবলে আসে নানা অশান্তি, অর্থকষ্ট, চাকরিতে ছেদ বা শত্রুতা, ব্যবসায় ক্ষতি, লেখাপড়ায় বাধা বা ছেদ, হাজতবাস, আকস্মিক দুর্ঘটনা, দুঃ খ-কষ্ট, বদনাম, অসৎ কর্মে ক্ষতি, প্রবল টেনশন, একাকীত্ব, বদহজম, অজীর্ণ রোগ, হাড় ভাঙ্গা, হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত যন্ত্রণা-ব্যথা, দীর্ঘ অসুস্থতা প্রভৃতি আরও নানা সমস্যা।
শনি অশুভ হয় মেষ, কর্কট, সিংহ ও বৃশ্চিক রাশিতে। শত্রু গ্রহগুলি চন্দ্র, মঙ্গল ও রবি। শনি তুঙ্গস্থ তুলা রাশিতে ও নীচস্থ হয় মেষ রাশিতে। শনি দ্বিতীয়ভাবে অশুভ হলে আর্থিক দিক, আয়, আত্মীয়-স্বজন, প্রাথমিক শিক্ষা, জমি-জায়গা, সম্পদ, পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে হয়। বহু ক্ষেত্রে আর্থিক ট্রমার মধ্যে বড় হতে হয়। ফলে শিশু বয়সে অভাববোধ মনে ছাপ ফেলে। অনেক সময় সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার তৈরি হয়, যা সারা জীবন বহন করতে হয়। গোচরে শনি কোনো জাতক বা জাতিকার জন্মছকের দ্বিতীয় ভাবের উপর দিয়ে যায় তখন তার পরিবারে আর্থিক অনটন বা ভালো খাবারের অভাব তৈরি হয়। অল্প বয়সে বাজে প্রভাবে মিথ্যে কথা বলা, মুখের ভাষা কটু হয়। ছোটবেলা থেকে নেশার শুরু করে, শিক্ষায় বাধা বা ছেদ পড়ে যায়। প্রথম জীবনে কষ্ট পেলেও 32 বছর থেকে 35 বছরের পর আর্থিক অবস্থা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করে। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক কখনোই কোনো সময়েই ভালো হবার নয়। শনি লগ্নস্থ, চতুর্থ, পঞ্চম বা নবম ঘরে নিজ গৃহে স্থিত হলে সাধারণত উন্নতি ঘটায়।

লগ্ন অনুযায়ী শনি সপ্তম ভাবে অশুভ বা পীড়িত হলে বিবাহে দেরী করায় বা বিবাহিত জীবন সুখের হয় না। এছাড়া জাতকের আয়, সম্পত্তি, বয়স, ব্যবসা মন বা আবেগকে প্রভাবিত করে। দাম্পত্য জীবনে নেমে আসে অশান্তি, যা ডিভোর্স পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। ব্যবসায় লোকসান, মান-সম্মান হানি, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকে না। নীচজন সঙ্গী বা বন্ধু হয়। সপ্তমে শনি আইন বিষয়ে উন্নতি ঘটায়।
শনি চতুর্থভাবে অবস্থান করলে পিতার সঙ্গে সম্পর্কহানি বা ধন-সম্পত্তি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। বন্ধুদের কাছ থেকে নিন্দা, অপবাদ আসে। দাম্পত্য জীবন বা পারিবারিক ক্ষেত্রে অশান্তি, দুঃখ-কষ্ট থাকে। গৃহ ও বাহন নষ্ট হয়। মাতা ও পিতার দুঃখের কারণ হয়।
Comments